ভিটামিন ডি এর অভাবের লক্ষণ - ভিটামিন ডি এর অভাব হলে করণীয় কাজ? বিস্তারিত জেনে নিন?
আজকে আমরা জানবো যে আমাদের শরীরে ভিটামিন ডি এর অভাবের লক্ষণ কি হতে পারে। ও তার সাথে সাথে এটাও জানবো যে ভিটামিন ডি এর অভাব হলে করণীয় কাজ গুলো কি কি। আসুন জানি?
ভিটামিন ডি এর অভাব জনিত লক্ষণঃ
আচ্ছা, বলুন তো সানশাইন ভিটামিন নামে পরিচিত কোন ভিটামিন? নিশ্চয়ই ভিটামিন ডি! কারণ এটি আমরা সূর্যের আলো থেকে পেয়ে থাকি।
ভিটামিন-ডি-এর-অভাব-জনিত-লক্ষণ |
এছাড়াও এটি হলো ফ্যাট সলিউবল বা চর্বি দ্বারা দ্রবনীয় ভিটামিন যা আমাদের দেহে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং ফসফরাস শোষণে সাহায্য করে। এটি শুধুমাত্র হাড় এবং দাঁতের গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং ইমিউন সিস্টেম, মানসিক স্বাস্থ্য এবং হৃদরোগ প্রতিরোধেও কাজ করে।
ভিটামিন ডি কিঃ
ভিটামিন ডি হলো একটি ফ্যাট-সলিউবল ভিটামিন যা আমাদের শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে, যা হাড় এবং দাঁতের গঠনে অপরিহার্য। ভিটামিন ডি এর দুটি প্রধান রূপ রয়েছে তাহলোঃ
- ভিটামিন ডি2 (এরগোক্যালসিফেরল) যা উদ্ভিজ্জ সূত্রে পাওয়া যায়।
- ভিটামিন ডি3 (কোলেক্যালসিফেরল) যা সূর্যালোকের মাধ্যমে ত্বকে তৈরি হয় এবং কিছু প্রাণিজ উৎসে পাওয়া যায়।
ভিটামিন ডি এর উৎসঃ
ভিটামিন ডি এর বিভিন্ন উৎস রয়েছে। যেমনঃ
১.সূর্যালোক
প্রাকৃতিক এবং প্রধান উৎস হলো সূর্যালোক। আমাদের ত্বক সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি (UVB) এর সংস্পর্শে এলে ৭-ডিহাইড্রোকোলেস্টেরল নামক একটি পদার্থের মাধ্যমে ভিটামিন ডি3 (কোলেক্যালসিফেরল) শরীরে উৎপন্ন হয়।
ভিটামিন ডি এর পর্যাপ্ত মাত্রা পাওয়ার জন্য প্রতিদিন ১৫-৩০ মিনিট সরাসরি সূর্যালোক গ্রহণ করা উচিত। অনেকের ধারণা সকাল ৬ থেকে ৮টার রোদে ভিটামিন ডি3 থাকে। এটা একটা প্রচলিত মিথ। বরং সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ভিটামিন ডি3 আমরা পেয়ে থাকি সূর্যের আলোতে। তবে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে ত্বক সুরক্ষার জন্য সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে।
২.খাদ্য
বিভিন্ন প্রানীজ খাবার এবং উদ্ভিজ্জ খাবার থেকে আমরা ভিটামিন ডি পেতে পারি। নীচে কিছু খাদ্যের তালিকা দেওয়া হলোঃ
৩.ফ্যাটি ফিশ
- রুই
- কাতলা
- ইলিশ
- চিংড়ি
- কই
- পাবদা
- টুনা
এসব মাছে ভিটামিন ডি এর উচ্চ মাত্রা পাওয়া যায়। ফ্যাটি ফিশ খাওয়া ভিটামিন ডি এর একটি ভালো উৎস।
৪.মাশরুম
কিছু মাশরুম প্রাকৃতিকভাবে ভিটামিন ডি উৎপন্ন করে, বিশেষ করে যেসব মাশরুম সূর্যের আলোতে জন্মায়।
৫.ডিমের কুসুম
ডিমের কুসুমে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। তবে পুরো ডিম না খেয়ে বরং ডিমের কুসুম খাওয়া উচিত।
৬.লিভার
গরু বা মুরগীর লিভার ভিটামিন ডি এর একটি ভালো উৎস। তাই ভিটামিন ডি এর ঘাটতি হলে কলিজা খান।
৭.দুগ্ধজাত পণ্য
দুধ, পনির, বাটার এবং দইয়ে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। কিছু দেশে দুগ্ধজাত পণ্যে ভিটামিন ডি সুরক্ষিত করা হয়।
৮.ফোর্টিফাইড খাদ্য
ভিটামিন ডি সুরক্ষিত (ফোর্টিফাইড) খাদ্য পণ্য যেমন সিরিয়াল, ওটমিল, জুস ইত্যাদি পাওয়া যায়। এই ধরনের খাদ্য পণ্য নিয়মিত খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
৯.সাপ্লিমেন্ট
যারা খাদ্য এবং সূর্যালোক থেকে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি পান না, তাদের জন্য সাপ্লিমেন্ট একটি ভালো বিকল্প হতে পারে। বাজারে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট পাওয়া যায়ঃ
ভিটামিন ডি2 (এরগোক্যালসিফেরল): উদ্ভিজ্জ থেকে প্রাপ্ত।
ভিটামিন ডি3 (কোলেক্যালসিফেরল): প্রাণিজ সূত্র থেকে প্রাপ্ত এবং সূর্যের আলোতে ত্বকে উৎপন্ন হয়।
ভিটামিন ডি এর প্রয়োজনীয়তাঃ
১.হাড়ের স্বাস্থ্য
ভিটামিন ডি ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাসের শোষণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে, যা হাড় এবং দাঁতের সঠিক গঠনের জন্য অপরিহার্য। এর অভাব হলে রিকেটস (শিশুদের মধ্যে) এবং অস্টিওমালাসিয়া (বয়স্কদের মধ্যে) হতে পারে।।
২.ইমিউন সিস্টেম
ভিটামিন ডি ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করে। এটি শরীরের ন্যাচারাল প্রটেক্টিভ সিস্টেমকে বৃদ্ধি করে এবং বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
৩.মানসিক স্বাস্থ্য
ভিটামিন ডি এর অভাব মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। এটি বিষণ্নতা কমাতে এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
৪.হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস
ভিটামিন ডি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। এর অভাব হৃদরোগের কারণ হতে পারে।।
ভিটামিন ডি এর উপকারিতাঃ
ভিটামিন ডি এর বিভিন্ন উপকারিতা রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান উপকারিতাগুলো হলোঃ
- হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি
এটি হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে এবং অস্টিওপরোসিসের ঝুঁকি কমায়। এতে হাড় শক্তিশালী হয় এবং সহজে ভাঙার ঝুঁকি কমে।
- ইনফ্লামেশন কমানো
ভিটামিন ডি শরীরের ইনফ্লামেশন কমাতে সাহায্য করে। এটি বিভিন্ন প্রদাহজনিত রোগের ঝুঁকি কমায়।
- ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি
ভিটামিন ডি ডায়াবেটিস রোগীদের ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এতে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
- ইমিউন ফাংশন উন্নত করা
এটি ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এটি শরীরের বিভিন্ন সংক্রমণ এবং রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
ভিটামিন ডি এর অভাবের লক্ষণঃ
যদি শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি না থাকে, তাহলে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। ভিটামিন ডি এর অভাবের কিছু লক্ষণ হলোঃ
- হাড় দুর্বল হয়ে যায় এবং সহজেই ভেঙে যেতে পারে।
- বিষণ্নতা, অবসাদ এবং মানসিক চাপ বাড়তে পারে।
ভিটামিন-ডি-এর-অভাবের-লক্ষণ |
- ইমিউন সিস্টেম কমে যায় এবং রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
- মানসিক কর্মক্ষমতা হ্রাস, স্মৃতিশক্তি হ্রাস এবং পর্যাপ্ত মনোযোগের সমস্যা হতে পারে।
- পেশীতে ব্যথা এবং দুর্বলতা অনুভব হতে পারে।
ভিটামিন ডি অভাবের কারণঃ
ভিটামিন ডি এর অভাব বিভিন্ন কারণে হতে পারে। যেমনঃ
- সূর্যালোকের অভাব
- ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাদ্যের অভাব
- কিছু রোগ যেমন কিডনি বা লিভারের সমস্যা, শরীরের শোষণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
- কিছু জিনগত কারণেও ভিটামিন ডি এর শোষণ কম হতে পারে।
ভিটামিন ডি এর অভাব ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিঃ
১. বয়স্ক ব্যক্তি
বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ত্বক ভিটামিন ডি তৈরি করার ক্ষমতা হারায়। এছাড়াও, বয়স্কদের শরীরে কিডনি কার্যক্ষমতা কমে যায়, যা ভিটামিন ডি এর শোষণকে বাধাগ্রস্থ করে।
২. গর্ভবতী মহিলা
গর্ভবতী মহিলাদের শরীরে ভিটামিন ডি এর প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায়। তাদের শরীরের জন্য এবং শিশুর পুষ্টির জন্য পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩. শিশু এবং নবজাতক
শিশু এবং নবজাতকের গঠন দ্রুত বৃদ্ধি পায়। তাদের হাড়ের গঠনের জন্য ভিটামিন ডি অপরিহার্য। প্রায়শই, মায়ের দুধে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি থাকে না, ফলে শিশুদের ভিটামিন ডি এর অভাব দেখা দেয়।
৪. কৃষ্ণ বর্নের মানুষ
কৃষ্ণ ত্বকের মানুষেরা সূর্যালোক থেকে ভিটামিন ডি কম শোষণ করে, কারণ তাদের ত্বকে মেলানিন বেশি থাকে যা ভিটামিন ডি উৎপাদনকে বাধাগ্রস্থ করে।
৫. লাইফ স্টাইল
যারা অধিকাংশ সময় ঘরের ভেতরে থাকে বা সূর্যালোক থেকে দূরে থাকে, তারা ভিটামিন ডি এর অভাবে থাকে বেশি। উদাহরণস্বরূপ, অফিস কর্মী, নাইট শিফট কর্মী।
৬. মোটা ব্যক্তি
মোটা ব্যক্তিদের শরীরে ভিটামিন ডি ফ্যাট টিস্যুতে আটকে যায়, যা শরীরের সঠিক পরিমাণে ভিটামিন ডি শোষণ বাধাগ্রস্থ করে।
৭. নিরামিষভোজী
যারা সম্পূর্ণভাবে নিরামিষভোজী, তাদের খাদ্যতালিকায় ভিটামিন ডি এর অভাব হতে পারে, কারণ বেশিরভাগ ভিটামিন ডি প্রাণীজ উৎস থেকে পাওয়া যায়।
এছাড়াও, কিছু রোগ যেমন ক্রনিক কিডনি রোগ, লিভার ডিজিজ, সিস্টিক ফাইব্রোসিস এবং ক্রোহন ডিজিজের রোগীদের ভিটামিন ডি এর শোষণে সমস্যা হয়।
ভিটামিন ডি অভাবের প্রতিকারঃ
ভিটামিন ডি এর অভাব হলে আমাদের শরীরের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। সঠিক প্রতিকার গ্রহণের মাধ্যমে আমরা এই অভাব পূরণ করতে পারি। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিকার উল্লেখ করা হলোঃ
- ভিটামিন ডি এর প্রধান উৎস হলো সূর্যালোক। প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য সরাসরি সূর্যালোক গ্রহণ করে ভিটামিন ডি এর প্রয়োজন মেটানো যায়। প্রতিদিন ১৫-৩০ মিনিট সরাসরি সূর্যের আলোতে থাকতে হবে।
- খাবারের মাধ্যমে ভিটামিন ডি এর অভাব পূরণ করা যেতে পারে। ফ্যাটি ফিশ,ডিমের কুসুম, মাশরুম, লিভার, ডিমের কুসুম, দুধ, পনির ইত্যাদি
- এছাড়াও, সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যালান্সড ডায়েট গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত ঘুম ভিটামিন ডি এর অভাব পূরণে সহায়ক।
লেখকের মক্তব্যঃ
ভিটামিন ডি আমাদের শরীরের জন্য অপরিহার্য একটি উপাদান, যা হাড়ের স্বাস্থ্য, ইমিউন সিস্টেম এবং মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়ক। সঠিক খাদ্য, পর্যাপ্ত সূর্যালোক এবং প্রয়োজনে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের মাধ্যমে ভিটামিন ডি এর প্রয়োজন মেটানো সম্ভব।
স্টাইলিশ এস এম নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হবে।
comment url